I tried so hard and got so far
But in the end, it doesn’t even matter
I had to fall to lose it all
But in the end, it doesn’t even matter
আপনার কাছে এটা হতে পারে কয়েকটা শব্দগুচ্ছের ৪ টা লাইন মাত্র, কিন্তু প্রতিটা "লিংকিন পার্ক" ভক্তের কাছে এটা আবেগমিশ্রিত অমৃতসুধা। যে সুধা পান করে প্রতিটা ভক্ত গিয়েছে চেতনার গন্ডির ওপারে, হয়েছে বেনিংটন মাদকে আসক্ত! এই যে চেস্টার বেনিংটন নামের সুরযন্ত্রটা এভাবে মাতিয়া রেখেছে পার্থিব বিষন্নতাকে, সেই ছাপচিত্রের পেছনের কাহিনীটা হয়ত অনেকেরই অজানা। নব্বই দশকের শেষে "লিংকিন পার্ক" নামক ব্যান্ড-খানা না তৈরি হলে হয়ত এভাবেই মহাকালের বিস্মৃতির গভীরতায় হারিয়ে যেত দুনিয়া কাঁপানো এক কিংবদন্তি।
মাদকাসক্তি, যৌন নিপীড়নের শিকার আর স্কুলে সহপাঠীদের বেদম মার খাওয়া - চেস্টার বেনিংটন এর গল্পের শুরুটা হয়েছিল বিভীষিকাময় কিছু জিনিস দিয়ে।১৯৭৬ সালের ২০ মার্চ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনাতে পুলিশ অফিসার বাবা ও নার্স মায়ের ঘরে চেস্টার বেনিংটনের জন্ম। কিন্তু বিধি যেখানে বাম, সেখানে অল্পতেই অসফলতার ছোঁয়া। ৭ বছর বয়সেই,
বয়সে বড় এক বন্ধুর দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হন তিনি। লজ্জায় কারো কাছে এই ঘটনা বলতে পারেননি, কয়েক বছর ধরে সবার অগোচরে সমানতালে চলতে থাকে এই নিপীড়ন। কথাটা একসময় চেস্টারের বাবার কানে গেলেও চেস্টার তখন কোনো আইনী ব্যবস্থা নিতে চাননি। কারণ তখন তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়েছিল, যে ছেলেটি তার সাথে অন্যায় আচরণ করেছিল, সে নিজেও এমনই এক অপরাধের শিকার হয়েছিল আগে। মূলত চেস্টারের জন্য বরাদ্দ দূর্ভাগ্যের তালিকা সেখান থেকেই শুরু। ১১ বছর বয়সে বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তাঁর। নিপীড়নের যন্ত্রণা আর একাকীত্ব, দুটোই যেন ঘাড়ে একেবারে জেঁকে বসেছিল একেবারে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো। ফলশ্রুতিতে, মাদকের সংস্পর্শে আসেন চেস্টার। অভিভাবক আর বন্ধুহীন জীবনে আফিম, মেথ, কোকেন আর অ্যালকোহল হয়ে ওঠে তার নিত্যদিনের সঙ্গী। বিরানব্বইয়ের দিকে মাদক থেকে কিছুটা দূরে থাকার চেষ্টা করলেও কাঠালের কাঠার মতো তা আবারো আত্মার সাথে জুড়ে গেলো। ২০১১ সালে,ওয়ার্ল্ড ট্যুর এর সময় মদ্যপান করেন প্রচুর আর বলেছিলেন – “I just don’t want to be that person anymore.”১৯৯৬ সালে যখম সামান্থা অলিট নামের এক তরুণীকে বিয়ে করেন তখনো জন্ম হয়নি লিংকিন পার্কের। এক পুত্রসন্তান-সহ এই জুটির ডিভোর্স হয় ২০০৫ সালে। পরের বছরই চেস্টার বিয়ে করেন তালিন্দা অ্যান বেন্টলিকে, এই স্ত্রীর সাথে সংসার করেছিলেন মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত।
ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে একসময় অ্যারিজোনা থেকে লস এঞ্জেলেসে পাড়ি দেন চেস্টার। এখানেই তিনি একটি ব্যান্ডের জন্য অডিশন দেন, পরবর্তীতে যেই ব্যান্ডের নাম হয় ‘লিংকিন পার্ক’। ব্যান্ডকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলতে কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকে দেন এই সুরের বাজিকর।ব্যান্ডের লাইন আপ পূর্ণতা পায় চেস্টারের উপস্থিতিতে। এই যে আজকে লিংকিন পার্কের "ঈর্ষণীয় সাফল্য" সেটা এনে দিয়েছেন এই চেস্টার নিজেই। কথায় আছে, "বিধাতা যারে দেয়, সবমতেই দেয়"। ফলে প্রথম এ্যালবাম ‘হাইব্রিড থিওরি’ দিয়েই বাজিমাত। উপরে যে চারটা লাইন লিখেছি এই লাইনগুলো সহ ‘ক্রলিং’, ‘ওয়ান স্টেপ ক্লোজার’, ‘ইন দি এন্ড’ আর ‘পেপারকাট’ এর মতো তুমুল জনপ্রিয় গানগুলো এই এ্যালবামের ফসল। দুই বছর গ্যাপ দিয়ে তারা বাজারে আনে তাদের ২য় অ্যালবাম‘মেটেওরা’। দুর্দান্ত ক্রেজে শীর্ষস্থান ধরে রাখে নতুন এই অ্যালবাম। সাথে, লিংকিন পার্ক যে একটা-দুটো হিট গানের ব্যান্ড নয়, সেটাও বেশ ভালোভাবেই প্রমাণ হয়ে যায়।আসলে তখন চাহিদা অনুযায়ী, নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার জন্য ‘মেটেওরা’র মতো একটা অ্যালবাম দরকার ছিল খুব। শ্রোতারা সেই অ্যালবাম ভালোভাবেই লুফে নেয়, সাথে লিংকিন পার্ক বিশ্ব সঙ্গীতে তাদের অবস্থানটা পোক্ত করে নেয়। এভাবেই চেস্টারের কাঁধে ভর করে পুরো " লিংকিন পার্ক" উঠে আয় সফলতার চূড়ায়। ২০০৫ সালে চেস্টার লিংকিন পার্কের পাশাপাশি নিজের একটি আলাদা ব্যান্ডে কাজ শুরু করেন। ‘ডেড বাই সানরাইজ’ নামের সেই ব্যান্ডের একটি মাত্র এ্যালবাম মুক্তি পেয়েছে। ‘লিংকিন পার্ক’ যখন সাফল্যের শিখরে, তখন আবার মাদকের কাছে ফিরে যান চেস্টার।
লিংকিন পার্ক ও বাংলাদেশঃ-
যদি ইতিহাস ঘেটে দেখেন তা দেখতে পাবেন, ৯০ দশকে অধিকাংশ কিশোরের ইংলিশ গানের হাতেখড়ি হয়েছে এই লিনকিং পার্ক দিয়ে। যারা ওইসময় ছিলেন, যদি ওরকম কেউ আমার পোস্ট পড়ে থাকেন তাহলে আপনারাই তা ভালো বলতে পারবেন। বাংলাদেশে লিংকিন পার্ক তথা চেস্টারের রয়েছে হাজার হাজার ভক্তকুল। তবে এখানে বেশ মজা একটা কাহিনী রয়েছে।২০১৫ সালে স্টেজলাইট কনটেস্ট জিতে লিংকিন পার্কের স্টুডিওতে কর্মশালার সুযোগ পেয়েছিলেন বাংলাদেশী সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার জায়েদ হাসান। ওইসময়চেস্টারের সঙ্গে বেশ হৃদ্যতা তৈরি হয় তার।দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় জায়েদ এভাবে স্মৃতিচারণ করেছেন চেস্টার কে নিয়ে-
“লিংকিন পার্কের স্টুডিওতে মাইক শিনোডা ও রব বোর্ডনের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম।
চেস্টার বেনিংটন তখনো পৌঁছাননি। বাড়ি থেকে বেরিয়েই নাকি জুতা কিনতে গেছেন। নতুন জুতা পরে স্টুডিওতে আসবেন। ভাবলাম, হয়তো আসবেনই না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি হাজির হয়ে হইচই জুড়ে দিলেন, নতুন জুতার আনন্দ!মাইক পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরও আমি চুপ করে ছিলাম। চেস্টার আমার পেটে একটা খোঁচা দিয়ে বললেন, স্যরি ম্যান, জুতাটা দরকার ছিল।“
এভাবেই চেস্টার গেঁথে রয়েছেন প্রতিটি বাংলাদেশী ফ্যান মনের কোণে!
চেস্টারের আত্মহত্যা ও একটি কালো অধ্যায়ঃ-
‘সাউন্ডগার্ডেন’ এবং ‘অডিওস্লেভ’ ব্যান্ড এর গায়ক ক্রিস কর্নেল ছিলেন চেস্টারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। চেস্টারের ক্যারিয়ারে বিশাল অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন সুহৃদ ক্রিস কর্নেল। বারংবার শ্রদ্ধার সাথে ক্রিস এর নাম উচ্চারণ করেছেন চেস্টার। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ক্রিস কর্নেলের ৫৩ তম জন্মদিনেই নিজের জীবনের ইতি টেনেছেন চেস্টার। সংবাদ সংস্থা সিএনএন তাদের খবরের শিরোনামে লেখে,
“Chester Bennington dies on his good friend Chris Cornell’s birthday”।
ক্রিস আর চেস্টার- দুজনের আত্নহত্যার ধরনের মধ্যেও মিল রয়েছে। দুজনেই হতাশা এবং মাদকাসক্তির ফলশ্রুতিতে আত্নাহুতি দেন। বন্ধু হারানোর যন্ত্রণা যে কতটা তীব্র হতে পারে, চেস্টার সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। নিজের জীবন দিয়ে সেটা বুঝিয়েও গেছেন বিশ্ববাসীকে। এবার পৃথিবীর রকপ্রেমীদের বোঝার পালা। যন্ত্রণায় বাস করতে করতে তাঁরা বুঁদ হয়েছেন ‘হাইব্রিড থিওরি’তে বা প্রিয় শিল্পীর অন্য গানগুলোতে
যেগুলোয় জীবন্ত চেস্টার বেনিংটন। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হতে পারে হতাশা। হতাশা এমন এক অসুখ, যার উপস্থিতি টের পাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব। লাখো ভক্তের ভালোবাসা, সাফল্য আর টাকা- কোনোটাই তাদের মানসিক শান্তি দিতে পারেনি। চেস্টার এই বিয়োগ কাঁদিয়েছে পুরো বিশ্বকে, স্তব্ধ করেছে নিঃশেষে, শোকের আলখাল্লা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে পুরো মিউজিক জগৎকে।
স্কুলে নিয়মিত সহপাঠীদের হাতে মার খাওয়া কৃশকায় শরীরের ছেলেটি হতাশার কাছে পরাজিত হয়ে চেষ্টা করেছিল গানের কাছে আশ্রয় খোঁজার। অবশতা দূরীকরণের পন্থা হিসেবে নিয়েছিলেন সংগীতের এলোমেলো ধ্রুপদী। তাইতো আমরা শুনতে পেরেছি,
"I've become so numb, I can't feel you there Become so tired, so much more aware By becoming this all I want to do Is be more like me and be less like you"....
স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শকের সামনে মঞ্চ কাঁপানো রকস্টারের ভেতরে যে এত অভিমান জমা ছিল, তা কয়জন জানতো? পুরষ্কার থেকে ভক্তদের ভালোবাসাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন সবসময়। ঝুলিতে গ্র্যামি এ্যাওয়ার্ড-এর মতো পুরষ্কার থাকতেও অহংকার করেননি বিন্দুমাত্র। পাকা ধানে কৃষক যেমনভাবে হাত বোলান, তেমনি নিজের হাতটাও বুলিয়ে নিতেন কনসার্টে নিজের ভক্তবৃন্দের মাঝে।
মাইক শিনোডার র্যাপ পার্ফরমেন্সের সাথে রোগা একজন লোক শার্টের বোতাম খুলে শ্রুতিমধুর কন্ঠে গান In the end গাইছে। হ্যাঁ, সে গায়কটা-ই আমাদের সবার প্রিয় প্রয়াত চেস্টার বেনিংটন। সে-ই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে হেভি মেটাল, হিপহপ, অলটারনেটিভ রক, ফাংক্, গ্রাংগ্ ঘরানা মিশ্রিত এক ভিন্ন ঘরানা, "ন্যু-মেটাল"। ওই প্রজন্ম বুঝতে পেরেছিল র্যাপ আর অল্টারনেটিভ রকেও অস্থির মেলোডি উপহার দেয়া যায়। চেস্টারই বুঝতে শিখিয়েছেন, অসাড়তার গন্ডিতে আবদ্ধ থাকার অনুভূতি, অনুভব করতে শিখিয়েছেন পঞ্চম মাত্রার এক জগৎকে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের প্রজন্মটা বড়ই হয়েছে চেস্টারকে বুকের মধ্যে আকড়ে ধরে, চেষ্টা করেছে কর্কশ গলায় গান গেয়ে ঘাড়ের রগ ফুলানোর। ডেড বাই সানরাইজ, গ্রে ডেইজ, স্টোন টেম্পল পাইলটস; প্রত্যেকটা ব্যান্ডেই রেখে গেছেন নিজের অসামান্য প্রতিভার ছিটেফোঁটা। ২০০০ সালের শুরু থেকে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, তাঁকে বিশ্বের অন্যতম সেরা রক মিউজিশিয়ান বলে গণ্য করা হত। হিট প্যারাডার নাম এক ম্যাগাজিন তাঁকে " সর্বকালের সেরা ১০০ মেটাল ভোকালিস্ট" এর তালিকায় ৪৬ নাম্বারে স্থান দিয়েছে।
শিল্প যদি মানসম্মত হয়, সময় তার অস্তিত্বে চিড় ধরাতে পারে না। সংগীত জগতে "অমরত্ব" নামে একটা শব্দ টুকে রাখা আছে। চেস্টার সেটা নিজের দখলে বাগিয়ে নিয়েছেন অসংখ্য ভক্তের মন জয় করে। ভক্তদের জন্য রেখে যাওয়া গান তারা অন্তরে ধারণ করবে চিরকাল।
হয়ত, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যারা চেস্টার নামক কিংবদন্তিকে দেখতে পারেনি তারাও হয়তো তাঁর রেখে যাওয়া অনবদ্য সৃষ্টিগুলো দৃষ্টিগোচর করে আফসোস করবে, গুগলে সার্চ করবে "Chester Bennington" লিখে। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েকে শোনাতে পারব এক কিংবদন্তির বীরগাথা, যার যুগ আমরা তাঁর গাওয়া গান শুনে কাটিয়েছি। একজন চেস্টারের বিয়োগ, মিউজিক ওয়ার্ল্ডে যে ক্ষতিপূরণ ঘটিয়েছে, তা এক বিরাট ক্ষত সৃষ্টি করেছে রকপ্রেমীদের হৃদয়ে। তাঁর ভুক্তভোগী আমি নিজেও। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ একজন চেস্টারের সময়ে পাঠানোর জন্য! প্রিয় গায়ক!
যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।💖