একটি অভ্যুত্থানের মহাকাব্য
দেশের যখন সংকট মুহূর্ত,যখন অন্তঃশত্রুর উল্লাস অভিযানে দেশের স্বাধীনতা ভূলুন্ঠিত,যখন রক্তচক্ষু শাসকের নির্যাতন চরমে,যখন স্বাধীনতার মোড়কে বেষ্টিত পরাধীনতার বিষজ্বালায় জর্জরিত মানুষ মুক্তি কামনায় উদ্বেল অস্থির, যখন রাষ্ট্রের শাসক নিজেই হয়ে পড়ে সর্বোচ্চ শোষক, আইনের রক্ষক যখন আবির্ভূত হয় ভক্ষকরূপে তখন রাষ্ট্রের মুক্তি হয়ে পড়ে অবশ্যম্ভাবী,সে অবশ্যম্ভাবীকে সম্ভব করতে প্রয়োজন হয় একটি বিপ্লবের, আর বিপ্লবের বীজ নিহিত থাকে একটি আইডিয়ার মধ্যে৷আইডিয়া মানে একটি স্ফূরণ,একটি জাগরণ, একটি অভ্যুত্থান৷ এই আইডিয়াই অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত জাতিকে মুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত করতে পারে, ক্ষমতার সুউচ্চ মসনদ থেকে অত্যাচারী শাসককে টেনে হিচড়ে নামিয়ে আনতে পারে জনতার কাতারে, একটি আইডিয়াই যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা দাসত্বের শৃংঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে পারে, উন্মোচন করতে পারে একটি নতুন দিগন্তের, যেখানে মনুষ্যসৃষ্ট বৈষম্যের বেড়াজাল ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে,সৃষ্টি হবে ভারসাম্য৷ আর এই আইডিয়া যাঁর মস্তৃষ্ক প্রসূত, যিনি এর ধারক ও বাহক,তিনি হন একজন নেতা, একজন বিপ্লবী৷ শত বছরের অপেক্ষার পর একজন নেতার আবির্ভাব ঘটে৷ আইডিয়ার ধারক যেহেতু মানুষ তাই তাঁর মৃত্যু হতে পারে৷ কিন্তু একটা আইডিয়ার কখনোই মৃত্যু হয় না৷ আইডিয়াকে বুলেটবিদ্ধ করা যায় না,আইডিয়া অবিনশ্বর,অনন্ত-অক্ষয়,অবিনাশী৷ বেনিয়া শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে একটা আইডিয়াই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হয়ে, একসময় হয়ে যায় যুগ পরিবর্তনের প্রধান নিয়ামক৷
নিকট ভবিষ্যতের ইংল্যান্ড৷ রাষ্ট্রনায়ক সাটলার পাড় করছেন ক্ষমতার চূড়ান্ত সময়৷ বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় উন্নতির চরম শেখরে অবস্থান করছে দেশ৷ কোথাও অশান্তি,বিশৃংঙ্খলা নেই৷ সর্বত্র বিদ্যমান সুখ আর সমৃর্দ্ধি কিন্তু রাষ্ট্রের ভেতরকার রূপ ঠিক উল্টো৷ সে রূপ বিভৎস আর কদর্যতায় পূর্ণ৷ নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নিজেই হরণ করছে নিরাপত্তা৷ নিরাপরাদ মানুষদের ধরে নিয়ে করা হচ্ছে অমানিক পরীক্ষণ,ধর্মকে হাতিয়ার করে চলছে স্বৈরাচারের ভিতকে শক্ত করার পায়তারা,রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপরীত চিন্তাধারীকে যেতে হচ্ছে দমন-পীড়ণের মধ্য দিয়ে এমনকি তাদেরকে হত্যা করতেও কুন্ঠিত হচ্ছে না শাসকগোষ্টী৷ বহুবছর ধরে চলা এ শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্র যেন নিজেই অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে, মানুষের মননে জং ধরে গেছে, মূক-বধির জনতার ব্যক্তিসত্ত্বা হয়ে পড়েছে ভোতা, রাহুগ্রস্থ মানুষ জীবন ধারনকেই মনে করছে অভিষ্ট লক্ষ্য৷ এমন অসার,জড়তাগ্রস্থ সিস্টেমে জমা হওয়া আবর্জনার স্তুপ ধোয়ে-মুছে সাফ করার জন্য, বহুবছরের পুরনো একটি আইডিয়া ধারণ করে, মুক্তির পয়গাম নিয়ে হাজির হন একজন ত্রাণকর্তা,A man under mask. মুখ তাঁর মুখোশে আর সারা দেহ তার কালো আলখাল্লায় ঢাকা৷
এ বেশেই তিনি রাষ্ট্র সংস্কারের মিশনে নামেন৷ সম্পূর্ণ একা আর নিঃসঙ্গ অবস্থায়৷ রাষ্ট্রের কিছু দুর্নীতিবাজ,লম্পট অফিসারদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে একটি মেয়েকে বাঁচানোর পর,তাঁর কিম্ভুতকিমাকার সাঁজ দেখে বিস্ময় নিয়ে মেয়েটি যখন জানতে চায়, Who are you? তখন তিনি বলেন," Who? Who is but the form following the function of what and what I am is a man in a mask. একটা ছোট মনোলগের মাধ্যমে তিনি যখন নিজ পরিচয়ের বর্ণনা দেন তখন বিস্ময় নিয়ে মেয়েটি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে,বিস্ময়ের শেষে তাঁর নাম জানা যায় "V"৷
V একটি রূপক, প্রতীকী নাম৷ এই নামের পেছনেও রয়েছে ইতিহাস৷ সে ইতিহাস নৃশংসতার, লোমহর্ষক আর ভয়ংকরের৷ অত্যাচারের সর্বোচ্চ সীমা থেকে বেঁচে ফেরা এক নির্যাতিতের বক্ষে দ্রোহের অনল নিয়ে জেগে উঠার গল্প৷কারাগারে এক ভয়াবহ এক্সপেরিমেন্টের মুখ থেকে কাকতালীয়ভাবে বেঁচে ফেরার গল্প৷ আত্মপরিচয়ের মনোলগে সে প্রায় চল্লিশটি V দ্বারা গঠিত শব্দের মাধ্যমে নিজের পরিচয় দেয় ৷ মুভির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রোমান হরফ V মানে পাঁচের ছড়াছড়ি৷ এমনকি ছিলো Faust থেকে নেয়া বিখ্যাত ডায়লগ, 'Vi Veri Veniversum Vivus Vici'. V কে যে কারাগারে থেকে অমানবিক পরীক্ষনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল সেটার নাম্বার ছিলো পাঁচ বা রোমান অক্ষর V.
আলোচিত সিনেমার নাম V for vendetta. এটি শুধু একটি সিনেমা নয়,এটি একটি বিপ্লবের মহাকাব্য৷এ মহাকাব্যের সূচনা হয় নারী কন্ঠে আবৃত্তি করা একটি কবিতার মাধ্যমে,
Remember, remember,
the fifth of November,
the Gunpowder Treason and Plot;
I know of no reason,
why the Gunpowder Treason,
should ever be forgot.
গান পাউডার ট্রিজন, বিপ্লবের পেছনের ইতিহাস,গল্পের পেছনের গল্প৷সালটা ছিল ১৬০৫৷ ব্রিটেনজুড়ে চলছে রাজা প্রথম জেমসের শাসন৷ খ্রীষ্টধর্মের তিনটি শাখার একটি হলো ক্যাথলিক৷ এসময় ক্যাথলিকদের উপর নেমে আসে অত্যাচারের খড়গহস্ত৷ ক্যাথলিক নিধন চলতে থাকে নির্বিচারে৷ ক্যাথলিকদের মনে রাজপরিবারের বিরুদ্ধে বিন্দু বিন্দু ক্ষোভ জন্মাতে শুরু করে একসময় তা সিন্ধুর আকার ধারণ করে৷ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ যা করে,সেটাই হলো৷ জন্ম দিল একটি আইডিয়া৷ গানপাউডার দিয়ে পুরো পার্লামেন্ট ভবন উড়িয়ে দেয়ার আইডিয়া ৷ এ গল্পের নায়ক দুজন, গাই ফকস আর রবার্ট ক্যাটসবি৷ ধার্য করা হলো পাঁচই নভেম্বর বাস্তবায়ন করা হবে আইডিয়া৷ পরিকল্পনা মোতাবেক গাই ফকস গান পাউডার আর শুকনো কাঠ নিয়ে উপস্থিত হন ঘটনাস্থলে৷ কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার দরুণ রাজপরিবার জেনে যায় ঘটনাটি৷ হাতে নাতে ধরা পড়ে গাই ফকস৷ এ অপরাধে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় গাই ফসকসের আর গুলি করে হত্যা করা হয় রবার্ট ক্যাটসবিকে৷ আপাত দৃষ্টিতে একটি আইডিয়ার মৃত্যু হতে দেখা যায়, একটি অভ্যুত্থান ব্যর্থ হতে দেখা যায়৷ কিন্তু আইডিয়ার মৃত্যু নেই, সময়ের প্রয়োজনে সে প্রবল বেগে ধেয়ে আসে দুর্নীতিগ্রস্থ রাষ্ট্রযন্ত্রকে নির্মূল করে দিতে৷ সিনেমার নায়ক V সে তেজে তেজোদীপ্ত একজন প্রতিবাদী৷
সিনেমার প্লট মূলত একই গঠনাকে উপজীব্য করে ১৯৯০ বের হওয়া এলান মুরের V for vendetta কমিক সিরিজের অনুকরণে তৈরী৷ DC Comics এর এই সিরিজের গ্রাফিকস আর্টিস্ট ছিলেন ডেভিড লয়েড৷ V এর মুখোশের পেছনের কারিগরও তিনি৷ এই মুখোশটা তখন খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠে৷ সিনেমার প্লট কমিকসের প্লট থেকে কিছুটা ভিন্ন৷ সিনেমা দেখার পর এলান মুর পরিচালকের প্রতি এতোটাই বিরক্ত ছিলেন স্টোরি রাইটার থেকে নিজের নামটা পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নেন৷ এলান মুর সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও লক্ষ কোটি সিনেপ্রেমীর চোখের মণি হয়ে আছে V for vendetta.
সিনেমার শুরুতেই বিস্ফোরণের মাধ্যমে আদালত ধ্বংস করে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিকট নিজের অস্তিত্বের জানান দেয় V. এতে সন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকেরা৷ স্বৈরাচারী সাটলার ঘোষণা দেয়, যে করেই হোক ধরতে হবে এ আতঙ্কবাজকে৷ দায়িত্ব পড়ে হেড অব পুলিশ ক্রিডি এবং ফিঞ্চের উপর৷ V কে খোঁজতে শুরু হয়ে যায় চিরুণী চল্লাশী৷ এদিকে হঠাৎ একদিন রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলকে জিম্মি করে V একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করে৷ এতে নির্জীব হয়ে পড়া জনগনকে গান পাউডার ট্রিজনের কথা মনে করিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্নীতি আর স্বৈরাচারের চিত্র তুলে ধরে ভোতা হয়ে যাওয়া চিন্তা শক্তিতে গতিসঞ্চারের আহবান জানান৷ ব্রিটেনের জনগনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আর যুদ্ধের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে জনতাকে কলুষণের বিরুদ্ধে পরিবর্তনের ডাক দেন৷ সেজন্য তিনি পরের বছরের পাঁচই নভেম্বর পার্লামেন্ট ভবণ উড়িয়ে দেবার বার্তা দেন৷ এ বার্তা জনমনে সুপ্ত প্রতিবাদের ঘিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ পরিবর্তনের এ ডাক আলোড়িত করে তাদের৷ দিন চলে যায়,এগিয়ে আসে পাঁচই নভেম্বর৷ এদিকে V থাকে ধরাছোঁয়ার বাহিরে৷ ফলে স্বৈরশাসকের আতঙ্ক অবস্থান করে চূড়ান্তসীমায়৷ নিছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয় পার্লামেন্ট ভবণের চারদিকে৷ পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকেও নামিয়ে দেয়া হয় মাঠে৷ এতো প্রতিকুলতার মধ্যে কি V পারবে তার এতোদিনের প্ল্যান সফল করতে?
জানতে হলে দেখতে হবে V for Vendetta সিনেমাটি৷
সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক তার সংলাপ৷ লিখে বাঁধাই করে রাখার মতো বহু সংলাপ আছে৷
”People shouldn’t be afraid of their government, Governments should be afraid of their people ”
"Everybody is special. Everybody. Everybody is a hero, a lover, a fool, a villain. Everybody. Everybody has their story to tell ”
” Happiness is the most insidious prison of all.”
কালো আলখাল্লায় দেহ আর মুখোশে মুখ ঢেকে পুরো সিনেমা জুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন V চরিত্রে হিউগো ওয়েভিং৷ একজন অভিনেতার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো অভিনয়ের সময় মুখের অভিব্যক্তি৷ কিন্তু এই অভিব্যক্তি প্রকাশের কোন সুযোগই ছিল না ওয়েভিংয়ের৷ সে অভাবটা বোধ হতে দেবেই না তাঁর কন্ঠ৷ জাদুকরী কন্ঠে ডায়লগ ডেলিভারি করে সম্পূর্ণ সিনেমা মাতিয়ে রেখেছেন তিনি৷ এ সিনেমায় অভিনয় করে অভিনয় সত্তাকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায় যেখানে দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো পর্দায় তাকিয়ে দেখা ছাড়া অন্য উপায় নেই৷
নাটালি পোর্টম্যান সমদক্ষতায় অভিনয় করে গিয়েছেন ওয়েভিংয়ের সাথে৷ সিনেমায় তাকে দুটি আলাদা লুকে দেখা যায়৷ প্রতিটি লুক আলাদা সত্তাকে বহন করে৷ সিনেমার পট পরিবর্তনে রয়েছে সত্তাদুটোর সম পরিমান ভুমিকা৷
সিনেমার আরেকটি শক্তিশালী দিক স্ক্রিনপ্লে৷ একটু সময়ের জন্যেও বোরিং লাগবে না এই স্ক্রিনপ্লের কারণে৷ ঘটনার পর ঘটনার উপস্থিতির যে নিরবিচ্ছিন্নতা,তা সিনেমাকে টান টান উত্তেজনায় রাখে পুরো সময়৷ সিনেমার পরিসমাপ্তি এনে দেবে তৃপ্তির ঢেকুর৷
সময়ের ব্যবধানে প্রতিটি রাষ্ট্রেই একজন করে V এর জন্ম হয়৷ অত্যাচারী ক্ষমতাধরের টুটি চেপে ধরে জনতার অধিকার ফিরিয়ে দিতে যুগে যুগে তাদের আবির্ভাব এক সজীব প্রফুল্লের বার্তা বয়ে আনে৷ ক্ষনজন্মা সেসব নায়কদের পদতলেই রচিত হয় ইতিহাসের নতুন অধ্যায়৷