"আমার কেবিনে কোন আয়না রাখা হয়নি, বদলে যাওয়া চেহারাটা দেখে যদি সেই ধাক্কাটা সইতে না পারি আমি- এই ভয়টা করেছিল ডাক্তারেরা। একজন নার্স সকালে একটা গামলায় পানি নিয়ে আসতেন আমার মুখ পরিস্কার করে দিতে- সেই পানির দিকে তাকিয়ে ব্যান্ডেজে ঢাকা বিকৃত চেহারাটার প্রতিচ্ছবি দেখে আঁতকে উঠতাম আমি। গায়ে অ্যাসিড পড়ার সেই মূহুর্তটার কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না, মনে হচ্ছিল, কেউ বুঝি আমার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে! এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা এর আগে কখনও পাইনি আমি। আমার হাত আর মুখ তখন শরীর থেকে আলাদা করে ফেললেও বোধহয় এতটা ব্যাথা পেতাম না আমি!"
কথাগুলো অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হওয়া ভারতীয় তরুণী লক্ষ্মী আগারওয়ালের। তার জন্ম হয়েছিল দিল্লীর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। বয়স যখন বছর পনেরো, তখন নাইম খান নামের এক লোক তার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। স্বাভাবিকভাবেই, সেটা প্রত্যাখ্যান করে লক্ষ্মীর পরিবার, কারণ তারা হিন্দু। লক্ষ্মী নিজেও সেই লোককে পছন্দ করতো না, নাইম খানের বয়সও ছিল তার দ্বিগুনেরও বেশি! প্রত্যাখ্যাত হবার পরে লোকটা আরও বেশি করে বিরক্ত করা শুরু করে লক্ষ্মীকে, পুলিশে অভিযোগ জানিয়েও নিস্তার পাওয়া যাচ্ছিল না তার হাত থেকে।
লক্ষ্মী তখন স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি দিল্লির খান মার্কেটে একটা বইয়ের দোকানে সহকারী হিসেবে কাজ করতো। ২০০৫ সালের কথা বলছি। এক সকালে বাসা থেকে হেঁটে খান মার্কেটের দিকে যাচ্ছিল লক্ষ্মী, দোকানের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে, এমন সময় রাস্তার উল্টোপাশ থেকে নাইম খানকে আসতে দেখলো সে। অন্যদিকে তাকিয়ে হেঁটে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো লক্ষ্মী, কিন্ত সে জানতো না, নাইম সেদিন খালি হাতে আসেনি। ছোট একটা বিয়ারের বোতলকে নিজের দিকে উড়ে আসতে দেখলো লক্ষ্মী, হাত বাড়িয়ে সেটা ঠেকানোর চেষ্টা করলো সে।
তারপরে কয়েকটা মূহুর্তে যেন নরক নেমে এলো কিশোরী লক্ষ্মীর ওপরে। বিয়ারের বোতলটা ছিল অ্যাসিডভর্তি, সেই তরলটা আঘাত করলো লক্ষ্মীর মুখে, হাতে। রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে চিৎকার করতে থাকলো মেয়েটা, আশেপাশের মানুষগুলো তখন হতভম্ভ হয়ে তাকে দেখছে! প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে এক ট্যাক্সিওয়ালা পাঁজাকোলা করে তাকে গাড়িতে ওঠালো, নিয়ে গেল হাসপাতালে। যমে মানুষে টানাটানি শুরু হলো, ডাক্তারদের হার না মানা মানসিকতা লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনলো মৃত্যুর মুখ থেকে। তবে সুন্দর মুখটাতে চিরদিনের জন্যে একটা দাগ বসে গেল তার।
লক্ষ্মীর গল্পটা এখানে শেষ হয়ে যেতে পারতো। ভারত বা বাংলাদেশের হাজার হাজার অ্যাসিডদগ্ধ নারী যেভাবে বাকিটা জীবন ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢেকে কাটিয়ে দেয়, লক্ষীও সেভাবে জীবন কাটাতে পারতো। কিন্ত লক্ষ্মী ঠিক করলো, এভাবে নয়, সে বাঁচবে বাঁচার মতো করে, কারো করুণার পাত্রী হয়ে নয়। ২০০৬ সালে হাইকোর্টে একটা পিআইএল দাখিল করলো সে, বেআইনীভাবে খোলা বাজারে এসিড বিক্রি বন্ধের দাবীতে। #StopSaleAcid নামের ক্যাম্পেইন নিয়ে সারাদেশে ঘুরলেন লক্ষ্মী। ২০১৩ সালে আদালত রায় দিলো, কোম্পানীর লাইসেন্স ছাড়া অ্যাসিড কেনাবেচা করা যাবে না, পুরো ব্যাপারটাতে সরকারের নজরদারী থাকতে হবে।
এর মাঝের সময়টাতে নিজের পড়ালেখা শেষ করেছেন লক্ষ্মী, একটা এনজিও খুলেছেন অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের সাহায্য করার জন্যে। ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে সতর্ক করেছেন, পথসভা করেছেন। ইন্টারনেট যখন সহজলভ্য হলো, তখন অনলাইন পিটিশন চালিয়েছেন, এরও আগে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষের স্বাক্ষর নিয়েছেন পিটিশনের জন্যে অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করিয়েছেন তরুণদের। ভারতে অ্যাসিডের আঘাতে ঝলসে যাওয়া নারীদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন তিনি।
সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা লক্ষীকে পুরস্কৃত করেছেন তার সাহসিকতা এবং পরিশ্রমের জন্যে, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন লক্ষ্মী, ভারত সরকারও যথাসাধ্য সাহায্য করেছে তাকে। লক্ষ্মীর ওপরে যে লোক অ্যাসিড হামলা করেছিল, আদালতে বিচার হয়েছে তারও। অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়েই পরিচয় হয়েছিল অলোক দিক্ষিত নামের এক তরুণের সঙ্গে, বন্ধুত্ব থেকে দুজনে হয়েছিলেন জীবনসঙ্গী, কিছুদিন আগে তারা আলাদাও হয়ে গিয়েছেন।
এক কন্যাসন্তানের জননী লক্ষ্মী তখন বেশ খানিকটা বেকায়দায় পড়েছিলেন, কারণ উপার্জন করার মতো কোন চাকুরি ছিল না তার। অনেকেই তাকে চাকুরি দিতে চেয়েছেন, কিন্ত লক্ষ্মীর আত্মসম্মানবোধ টনটনে, কারো করুণার পাত্রী হবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও তার ছিল না। লক্ষ্মী বলেছিলেন, যদি সরকার থেকে তাকে কোন চাকুরির প্রস্তাব দেয়া হয়, তাহলেই তিনি ভেবে দেখবেন। পরে একটা টিভি চ্যানেলের উপস্থাপিকা হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি।
লক্ষ্মী আগারওয়ালের জীবনটা সিনেমার চেয়েও বেশি নাটকীয়, সেখানে সুখের চেয়ে কষ্টটা বেশি, সংগ্রামী সেই পথটা ভীষণ কণ্টকাকীর্ণ। সেই জীবনটাকেই এবার সিনেমায় ফুটিয়ে তুলতে চলেছেন দীপিকা পাড়ুকোন, ক্যামেরার পেছনে আছেন আরেক মাস্টারমেকার মেঘনা গুলজার। সিনেমার নাম 'ছপাক', সেটার ফার্স্ট লুক রিলিজ পেলো আজ সকালেই।
ইনস্ট্যাগ্রামে আপলোড করা দিপীকার ছবিটা দেখে অবাক হয়েছেন অনেকেই। গালের একপাশ ক্ষতবিক্ষত, অ্যাসিডের আঘাতে পুড়ে যাওয়া চামড়া; মানবসৃষ্ট বিভৎসতার ভয়াবহ এক নমুনা যেন! এরমধ্যেও দৃষ্টি কেড়ে নেয় মায়াবী চোখজোড়া- অ্যাসিড আক্রান্ত নারী হিসেবে নিজেকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার জন্যেই দীপিকার এই বেশভূষা। চরিত্রের নাম মালতী, ইনস্ট্যাগ্রামে ছবিটা শেয়ার দিয়ে দীপিকা লিখেছেন- 'এমন একটি চরিত্র, যা আমার সঙ্গে সারাজীবন থাকবে...মালতী।'
নেক্সট প্রোজেক্ট নিয়ে দীপিকা বেশ উচ্ছ্বসিত, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। সিনেমা মুক্তির পরেও এই উচ্ছ্বাসটা টিকে থাকবে, এটাই কামনা। আরেকটা চাওয়া থাকবে, সিনেমার ডামাডোল কিংবা গ্ল্যামারের ভীড়ে যাতে বাস্তবের লক্ষ্মী আগারওয়ালের সংগ্রামটাকে কেউ ভুলে না যায়...